নগ্ন ছবি দিয়ে ভারতীয়দের ব্ল্যাকমেইল করার ব্যবসা ফাঁস
তাৎক্ষণিক ঋণ পাইয়ে দেয়ার কয়েকটি অ্যাপ ব্যবহার করে ভারতসহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে ফাঁদে ফেলার এক অবৈধ কারবার চলছে। ভারতে অন্তত ৬০ জন এই ফাঁদে পা দিয়ে নির্যাতন আর অপমানের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
ভারত আর চীনে এই অবৈধ কারবারগুলোতে বিবিসি এক গোপন তদন্ত চালিয়েছে।
আস্থা সিনহার ঘুমটা ভেঙ্গেছিল ফোনের অপর প্রান্তে তার খালার আতঙ্কিত কথাগুলো শুনে।
কথাগুলো থেকে একটি ছিল, ‘তোমার মাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিও না।’
পাশের ঘরে তার মা ভূমি সিনহাকে উদভ্রান্তের মতো কান্নাকাটি করতে দেখে আধা-ঘুমের মধ্যেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল ১৭ বছর বয়সী মেয়েটি।
তার যে হাসি-খুশি আর নির্ভীক মা, যিনি মুম্বাইয়ের একজন সম্মানিত আইনজীবী, একজন বিধবা হয়েও মেয়েকে একা বড় করার দায়িত্ব সামলান, সেই তিনি যেন একেবারে ভেঙে পড়েছেন।
‘মা একদম ভেঙে পড়েছিল’
আস্থার মা জমিজমা-সংক্রান্ত আইন নিয়ে কাজ করেন।
আস্থা বলেন, ‘মা একদম ভেঙে পড়েছিল’।
আতঙ্কিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র কোথায় কী আছে। বিপদের সময়ে কাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে সেইসব মেয়েকে বোঝাতে শুরু করেছিলেন ভূমি সিনহা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন বাড়ি থেকে বেরতে চাইছিলেন।
আস্থা শুধু জানতেন যে মাকে আটকাতে হবে যে করেই হোক।
তার খালা যে আগেই সাবধান করে দিয়েছেন, ‘একদম চোখের আড়াল করবে না’।
তার খালা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘ও কিন্তু নিজের জীবনটা শেষ করে দেবে’।
আস্থা এটুকুই শুধু জানতেন যে তার মায়ের কাছে কিছু অদ্ভুত ফোন আসছে। আর তার কাছে কেউ একটা টাকা পায়। তবে তিনি এটা জানতেন না যে তার মাকে গত কয়েক মাস ধরে কীভাবে হয়রানি আর মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছিল।
নির্মম ব্যবসা
অন্তত ১৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এক আন্তর্জাতিক প্রতারণা চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন ভূমি সিনহা। যে চক্রটির কাজই হচ্ছে ব্ল্যাকমেইল করে, মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিয়ে মুনাফা লোটা।
এই ব্যবসার নিয়মটা নির্মম, কিন্তু খুবই সোজাসাপ্টা।
এমন অনেক অ্যাপ রয়েছে যা কয়েক মিনিটের মধ্যে কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়াই ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এগুলোর সবাই যে শিকারের আশায় ফাঁদ পেতে থাকে তা নয়। কিন্তু অনেকগুলোই সে ধরনের। একবার অ্যাপ ডাউনলোড হয়ে গেলে আপনার পরিচিতি, ছবি এবং পরিচয়পত্র সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে পরে সেই তথ্য ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করে।
গ্রাহকরা যখন সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন না অথবা কখনো ঋণ শোধ হয়ে যাওয়ার পরেও ওই অ্যাপগুলো আপনার তথ্য কোনো কল সেন্টারে দিয়ে দেয়। সেখানে ল্যাপটপ আর ফোন নিয়ে বসে থাকে কিছু তরুণ এজেন্ট। যাদের প্রশিক্ষণই হয়েছে কী করে মানুষকে অপমান আর হয়রান করে ঋণ পরিশোধ করার জন্য চাপ দিতে হয়।
৪৭ হাজারের ঋণ বেড়ে ২০ লাখ
এরকমই কয়েকটা অ্যাপ থেকে ভূমি সিনহা প্রায় ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ২০২১ সালের শেষ দিকে। কাজের জায়গায় কিছু পাওনা টাকা আটকিয়ে ছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই টাকা চলে আসার কথা ছিল। স্বল্পমেয়াদী ঋণটার দরকার হয়েছিল সেজন্যই।
ঋণের টাকা তো প্রায় সাথে সাথেই চলে এল। কিন্তু একটা বড় অংশ কেটে নেয়া হল বিভিন্ন চার্জের নাম করে।
তার ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল সাত দিনের মধ্যে। কিন্তু তিনি যে টাকাটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সিনহা, সেটা তখনো তিনি পাননি।
তাই ধার শোধ করার জন্য তিনি আবার অন্য একটি অ্যাপ থেকে ঋণ নিলেন। তারপরে আরো একটি অ্যাপ থেকে। বাড়তে বাড়তে আসল আর সুদ মিলিয়ে ততদিনে তার মোট দেনা হয়ে গেছে ২০ লাখ টাকা।
কদিনের মধ্যেই এজেন্টরা ফোন করতে শুরু করল। সেই সব কলে নোংরা কথা বলা হত, সিনহাকে গালাগালি দেয়া হত, অপমান করা হত।
এমনকি যখন তিনি ঋণ পরিশোধ করে দিলেন। তখনো ফোন করা বন্ধ হয়নি। বলা হত যে তিনি নাকি মিথ্যা কথা বলছেন যে ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছেন।
দিনে ২০০টা পর্যন্ত ফোন পেয়েছেন তিনি।
তার বাড়ি কোথায়, সেটা জানত ওই এজেন্টরা আর তাকে হুমকি দেয়ার জন্য বাড়িতে একটা লাশের ছবি পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল।
নির্যাতন বাড়তে বাড়তে এমনপর্যায়ে পৌঁছিয়েছিল যে ওই এজেন্টরা তাকে হুমকি দিয়েছিল। ফোনের কন্টাক্ট লিস্টের ৪৮৬ জনের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে বলে দেবে যে তিনি একজন চোর আর পতিতা। এমনকি তারা মেয়েকেও বদনাম করে দেয়ার হুমকি যখন দেয় তখন থেকে সিনহার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল।
সহকর্মীর কাছে ‘নগ্ন’ ছবি
তিনি বন্ধু, পরিবার আর অন্য ৬৯টি অ্যাপ থেকে টাকা ধার করতে শুরু করেন। রাতে তিনি প্রার্থনা করতেন, সকাল যেন আর না আসে।
কিন্তু ঠিক সকাল ৭টায় ফোন বাজতে শুরু করত।
শেষ পর্যন্ত, ভূমি সিনহা সব ধার মিটিয়ে দিতে সমর্থ হন। কিন্তু ‘আসান লোন’ নামের একটি অ্যাপ তা সত্ত্বেও ফোন করা বন্ধ করেনি।
মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে কাজেও মন দিতে পারছিলেন না। শুরু হয়েছিল তার প্যানিক অ্যাটাক।
একদিন এক সহকর্মী তাকে তার টেবিলে ডেকে ফোনে দেখালেন ভূমি সিনহারই একটি নগ্ন, পর্নোগ্রাফিক ছবি।
ছবিটি খুব খারাপ ভাবে ফটোশপ করা হয়েছিল। সিনহার মাথা অন্য একজনের শরীরে কেটে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল।
লজ্জা আর ঘৃণায় সহকর্মীর টেবিলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি।
ওই ছবিটি ‘আসান লোন’ অ্যাপ থেকে তার ফোন বুকের প্রতিটি নম্বরের কাছে পাঠানো হয়েছিল।
তখনই ভূমি সিনহা আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন।
অন্তত ৬০ জনের আত্মহত্যা
সারা বিশ্বে বিভিন্ন কোম্পানি এ ধরনের প্রতারণা চক্র যে চালায়, তার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি। শুধু ভারতেই অন্তত ৬০ জন মানুষ লোন অ্যাপের হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে জেনেছে বিবিসি।
যারা আত্মহত্যা করেছেন, তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। এদের মধ্যে রয়েছেন একজন দমকলকর্মী, একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী, এক অল্পবয়সী দম্পতি যারা তাদের তিন আর পাঁচ বছরের দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করেন। রয়েছেন এক দাদু এবং তার নাতি, চারজন টিনএজার, যারা লোন অ্যাপের ফাঁদে পড়ে নিজেদের জীবন শেষ করে দিয়েছেন।
বেশিরভাগ ভুক্তভোগী লজ্জায় এই প্রতারণার ফাঁদের কথা বলতে পারেন না। আর অপরাধীদের বেশিরভাগই অনামী, অদৃশ্য।
প্রতারণা চক্রের কাউকে খুঁজে বার করার জন্য বিবিসি কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালিয়েছে।
অবশেষে এক যুবককে খুঁজে পাওয়া যায়, যিনি একাধিক লোন অ্যাপের রিকভারি এজেন্ট হিসাবে একটি কল সেন্টারে কাজ করতেন।
‘রোহন’ এগিয়ে এলেন তদন্তে
রোহন তার মূল নাম নয়।
আমাদের তিনি বলেছিলেন যে তাকে ওই নির্যাতনের সাক্ষী থাকতে হয়েছিল। একটা সময়ে তিনি নিজেও এই অত্যাচারে মানসিক অশান্তিতে ছিলেন।
রোহন জানান, ‘অনেক গ্রাহক কাঁদতে থাকেন, কেউ আত্মহত্যা করবেন বলে শাসান।
এগুলো আমাকে সারা রাত কষ্ট দিত।’
তিনি এই প্রতারণা চক্র ফাঁস করতে বিবিসিকে সাহায্য করতে রাজী হন।
‘ম্যাজেস্টি লিগ্যাল সার্ভিসেস’ এবং ‘কলফ্লেক্স কর্পোরেশন’ নামে দুটি আলাদা কল সেন্টারে চাকরির জন্য আবেদন করেন তিনি। কয়েক সপ্তাহ ধরে গোপনে ভিডিও রেকর্ডিং করতে থাকেন তিনি ।
তার ভিডিওতে দেখা গেছে যে কম বয়সী এজেন্টরা কীভাবে ঋণগ্রহীতাদের হয়রানি করছে।
এক নারী এজেন্টকে গালাগালি দিয়ে বলতে শোনা গেছে, ‘আচরণ ঠিক করো, না হলে ঘুঁষি মেরে দেব।’
ওই নারী এজেন্ট তার গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের কথা বলেন, অথচ সেই গ্রাহক ফোনটা ছাড়ার সাথে সাথেই নারী এজেন্ট হাসিতে ফেটে পড়েন। আরেকজন এজেন্ট আবার পরামর্শ দেয় যে ওই গ্রাহকের উচিত ঋণ পরিশোধের জন্য নিজের মাকে যৌন কাজে নামানো।
রোহন ১০০টিরও বেশি হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করেছেন। এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা ক্যামেরায় ধরা পড়ল।
সব থেকে নিকৃষ্ট নির্যাতনের ঘটনা রোহন যা দেখতে পেয়েছেন, তা ঘটেছে দিল্লির ঠিক বাইরে অবস্থিত কলফ্লেক্স কর্পোরেশনে। এখানে এজেন্টরা গ্রাহকদের অপমান ও হুমকি দেয়ার জন্য নিয়মিত অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। তারা কিন্তু এগুলো করত বিচ্ছিন্নভাবে নয়। রীতিমতো কল সেন্টার ম্যানেজারদের নজরদারী আর নির্দেশনায় করা হত সবকিছু।
বিবিসির গোপন ক্যামেরায় যা ধরা পড়ল ম্যানেজারদের মধ্যে একজনের নাম বিশাল চৌরাসিয়া।
রোহান চৌরাসিয়ার আস্থা জিতে নেন এবং একজন সাংবাদিককে বিনিয়োগকারী হিসাবে পরিচয় দিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। তারা চৌরাসিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে গোটা চক্রটা কীভাবে কাজ করে।
চৌরাসিয়ার কথায়, যখন কোনো গ্রাহক ঋণ নেন তখন তারা অ্যাপটিকে ফোনের কন্টাক্ট লিস্টের অ্যাক্সেস দেন। কলফ্লেক্স কর্পোরেশনকে ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ভাড়া করা হয়। যদি গ্রাহক কোনো টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হন, তখন তাদের হয়রানি করা শুরু হয়। পরিচিতজনেদের কাছেও ফোন করা হতে থাকে।
চৌরাসিয়া তাদের বলেছিলেন, যতক্ষণ না তারা ঋণ দেয়া অর্থ ফেরত পাচ্ছে, ততক্ষণ তার কর্মীরা যেকোনো কিছু বলতে পারে।
তিনি বলছিলেন ‘গ্রাহক তখন লজ্জায় টাকা ফেরত দেয়। আপনি তার কন্টাক্ট লিস্টে অন্তত একজনকে পাবেন যাকে ফোন করলেই তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।’
আমরা সরাসরি চৌরাসিয়ার সাথে যোগাযোগ করেছি কিন্তু তিনি মন্তব্য করতে চাননি। কলফ্লেক্স কর্পোরেশনের সাথেও আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।
সিভিল সার্ভিসে কর্মরত মৌনিকা
অনেক জীবনের মতোই কির্নি মৌনিকার জীবনও শেষ হয়ে গেছে।
মিজ কির্নির বয়স ২৪ বছর হলেও ওই সিভিল সার্ভিসে কর্মরত ওই নারীই ছিলেন গোটা পরিবারের মস্তিষ্কের মতো। তার স্কুলের একমাত্র ছাত্রী ছিলেন তিনি, যে সরকারি চাকরি পেয়েছিল। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন ছিলেন তিনি। বাবা একজন সফল কৃষক।
অস্ট্রেলিয়ায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য মেয়েকে সবধরনের সাহায্য করতে তৈরি ছিলেন বাবা।
তিন বছর আগে যে সোমবার তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, সেদিন তিনি যথারীতি কাজে যাওয়ার জন্য স্কুটারে চেপে বেরিয়েছিলেন।
তার বাবা কির্নি ভূপানি বললেন, ‘বেশ হাসি খুশিই তো ছিল সেদিন।’
পুলিশ যখন মৌনিকার ফোন এবং ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে, তখনই জানা যায় যে তিনি ৫৫টি বিভিন্ন লোন অ্যাপ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। শুরুটা হয়েছিল মাত্র ১০ হাজার টাকার একটা ঋণ দিয়ে। তারপরে তা বাড়তে বাড়তে ৩০ গুণে গিয়ে দাঁড়ায়।
যখন তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ততক্ষণে তিনি তিন লাখ টাকারও বেশি ফেরতও দিয়ে দিয়েছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে যে অ্যাপগুলো তাকে ফোন করে আর অশ্লীল মেসেজ পাঠিয়ে হয়রানি করেছিল আর তার পরিচিতদেরও মেসেজ পাঠাতে শুরু করেছিল।
মৌনিকার ঘরটি এখন একটি পুজোর ঘরের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তার সরকারি পরিচয়পত্র দরজার কাছে ঝুলছে। মেয়ে একটা বিয়ে বাড়িতে যাবে বলে তার মা যে ব্যাগটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাও সেভাবেই রাখা রয়েছে।
যে বিষয়টি তার বাবাকে সবথেকে বেশি করে আঘাত দেয়, যে মেয়ে তাকে ঘুণাক্ষরেও বলেনি যে কী ঘটছে।
চোখের জল মুছতে মুছতে কির্নি ভূপানি বলছিলেন, ‘আমরা খুব সহজেই টাকার ব্যবস্থা করতে পারতাম’।
লাশ নিয়ে ফেরার সময়েও হুমকি ফোন
যারা ওই ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের ওপরে সাংঘাতিক রাগ তার।
তিনি যখন হাসপাতাল থেকে মেয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি আসছেন। তখনো মৌনিকার ফোন বেজে উঠেছিল। তিনি ফোনটা তুলতেই অপর দিক থেকে অশ্লীল কথা শুনতে হল তাকে।
তারা বলছিল, ‘মেয়েকে টাকা ফেরত দিতেই হবে।’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ও মারা গেছে।’
তিনি অবাক হয়ে ভাবেন কারা এই নরখাদকগুলো।
হরি একটা ছদ্মনাম। তিনি এমন একটা কল সেন্টারে কাজ করতেন যেটি মৌনিকা যে অ্যাপগুলো থেকে ধার নিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে একটির জন্য ঋণ পুনরুদ্ধারের কাজ করত।
বেতন ভালো ছিল তবে মৌনিকা যখন মারা যান, ততদিনে হরিরও মন ভেঙে যাচ্ছিল যে তিনি এরকম একটা কাজের অংশ।
যদিও তিনি দাবি করেছেন যে তিনি নিজে গালাগালি দেয়া কলগুলো করতেন না। ঋণ পরিশোধের জন্য গোড়ার দিকে যারা ভদ্রভাবে কথা বলত, তিনি সেই টিমের সদস্য ছিলেন। তবে তিনি আমাদের বলেছেন যে ম্যানেজাররা কর্মীদের গালিগালাজ এবং হুমকি দেয়ার নির্দেশ দিতেন।
ঋণ গ্রহীতাদের কন্টাক্ট লিস্টে থাকা ব্যক্তিদের কাছে এইসব এজেন্টরা তার নামে প্রতারক আর চোর অপবাদ দিয়ে মেসেজ পাঠাত।
হরি বলছিলেন, ‘প্রত্যেকেরই তাদের পরিবারের সামনে সুনাম বজায় রাখতে চায়। মাত্র পাঁচ হাজার টাকার জন্য কেউ কি সেই সুনাম নষ্ট করতে পারে?‘
যখনই ঋণের টাকা ফেরত চলে আসবে, কম্পিউটারে দেখানো হবে ‘সফল’ আর এজেন্টরা অন্য গ্রাহকের দিকে মনোযোগ দেবে।
যখন গ্রাহকরা হুমকি দিতে শুরু করেন যে তারা আত্মহত্যা করবেন। প্রথম কেউ সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তারপরে সত্যিই আত্মহত্যা শুরু হল।
কর্মীরা তাদের মালিক পরশুরাম তাকভেকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তাদের এবার থামা উচিত কী না।
পরের দিন তাকভে অফিসে হাজির হন। তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা বলা হয়েছে, সেটা কর, ঋণের অর্থ ফেরত নিয়ে এসো’।
কয়েক মাস পর মৌনিকা মারা যান।
গোপন ক্যামেরায় চীনা ব্যবসায়ীর বয়ান
তাকভে নিষ্ঠুর ছিল। কিন্তু তিনি একা এই অপারেশন পরিচালনা করতেন না।
হরির কথায়, ‘কখনো কখনো হঠাৎ করেই সফটওয়্যার ইন্টারফেসটি চীনা ভাষায় হয়ে যেত।’
তাকভে লিয়াং তিয়ান তিয়ান নামে এক চীনা নারীকে বিয়ে করেছিলেন। তারা একসাথে পুনেতে ‘জিয়ালিয়াং’ নামে ঋণ পুনরুদ্ধারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেখানেই কাজ করতেন হরি।
তাকভে আর মিজ লিয়াংকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ একবার গ্রেফতার করেছিল হয়রানির একটি মামলায়। তারা কয়েক মাস পরে জামিনে পেয়ে যান।
তাদের নামে চার্জশীট দেওয়া হয় ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। তাদের বিরুদ্ধে জোর করে টাকা আদায়, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়। গত বছরের শেষ দিকে তারা পালিয়ে যান।
আমরা তাকভেকে খুঁজে বের করতে পারিনি। কিন্তু আমরা যখন তদন্ত করে খুঁজে বার করলাম যে কোন লোন অ্যাপগুলোর জন্য জিয়ালিয়াং কাজ করত। সেখান থেকে আমরা খুঁজে পেলাম লি জিয়াং নামে এক চীনা ব্যবসায়ীকে।
ইন্টারনেটে তার কোনো উপস্থিতি নেই, তবে আমরা তার এক কর্মচারীর ফোন নম্বর খুঁজে পাই আর বিনিয়োগকারী হিসাবে পরিচয় দিয়ে লি-এর সাথে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করি।
তার মুখটা ক্যামেরার এতটাই কাছে চলে এসেছিল যে আমাদের অস্বস্তি হচ্ছিল। তিনি ভারতে তার ব্যবসা নিয়ে গর্ব করছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এখনো কাজ করছি। শুধু ভারতীয়দের জানতে দিচ্ছি না যে আমরা একটি চীনা সংস্থা।’
লি-এর দুটি সংস্থায় ২০২১ সালে ভারতীয় পুলিশ তল্লাশি চালায় লোন অ্যাপের তরফে হয়রানির অভিযোগ এনে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়।
তার কথায়, ‘আপনাকে বুঝতে হবে যে যেহেতু আমরা আমাদের বিনিয়োগ দ্রুত ফেরত চাই, তাই আমরা অবশ্যই স্থানীয় কর দিই না আর আমরা যে হারে সুদ দিই সেটাও স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করে।’
লি আমাদের বলেছিলেন যে তার সংস্থার নিজস্ব লোন অ্যাপ রয়েছে ভারত, মেক্সিকো আর কলম্বিয়ায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ ও ঋণ পরিশোধ পরিষেবা ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে অগ্রণী বলে দাবি করেন। এখন তিনি ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকা জুড়ে ব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারতে তিন হাজারেরও বেশি কর্মী নিয়ে ‘ঋণ-পরবর্তী পরিষেবা’ দিতে তিনি প্রস্তুত।
সমাজ দূরে সরিয়ে দিয়েছে
তিনি বোঝাচ্ছিলেন যে তার সংস্থা ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কী করে।
ব্যাখ্যা করেছিলেন লি, ‘আপনি যদি ঋণ পরিশোধ না করেন তবে আমরা আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করব। তৃতীয় দিনে আমরা আপনাকে একইসাথে হোয়াটসঅ্যাপে কল করব আর মেসেজ করব আবার কন্টাক্ট লিস্টে থাকা ব্যক্তিদেরও কল করব। তারপরে চতুর্থ দিনে আপনার ঘনিষ্ঠরা যদি ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে তাহলে বিশদ পদ্ধতি আছে আমাদের।‘
লি আরো বলেন, ‘আমরা গ্রাহকদের কল রেকর্ড অ্যাক্সেস করতে পারি এবং অন্য অনেক তথ্যই পেয়ে যাই। মূলত এটা একরকম আমাদের সামনে তার নগ্ন চেহারাটা ধরা পড়ে।’
হয়রানি, হুমকি, গালাগালিতে ক্লান্ত হলেও সেগুলো সহ্য করে নিতে পারতেন ভূমি সিনহা, কিন্তু একটা পর্নোগ্রাফিক ছবির সাথে তার চেহারা জুড়ে যাওয়ার লজ্জা সহ্য করা অসম্ভব ছিল তার পক্ষে।
সিনহা জানান, ‘ওই মেসেজটি আসলে পুরো বিশ্বের সামনে আমাকে নগ্ন করে দিয়েছিল।’
তার কথায়, ‘এক সেকেন্ডের মধ্যে আমার আত্মসম্মান, আমার নৈতিকতা, আমার মর্যাদা, সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি।’
ওই ছবিটা আইনজীবী, স্থপতি, সরকারি কর্মকর্তা, বয়স্ক আত্মীয় স্বজন, এমনকি তার বাবা-মায়ের বন্ধুদের কাছেও পাঠানো হয়েছিল। যারা তাকে আগের নজরে আর কখনই দেখবেন না।
সিনহা বলেন, ‘মূলত আমি যা, সেটাকেই কলঙ্কিত করেছে ওই ছবিটা। অনেকটা, যেমন আপনি যদি একটি ভাঙা কাঁচকে জোড়া দেন, তাও ফাটলের দাগগুলো কিন্তু থেকেই যাবে।’
যে পাড়ায় তিনি ৪০ বছর ধরে বসবাস করছেন, তারাও তাকে আলাদা করে দিয়েছে।
একটা কষ্টের হাসি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ আমার কোনো বন্ধু নেই। মনে হয় যেন শুধুই আমিই আছি।’
তার পরিবারের কেউ কেউ এখনো তার সাথে কথা বলে না। তার সবসময়ে মনে হয় যে তার পুরুষ সহকর্মীরা কি তাকে নগ্ন ভাবে চিন্তা করছে?
সকালবেলা তার মেয়ে আস্থা তাকে একেবারে ভেঙে পড়া অবস্থায় দেখেছিল, সেই মুহূর্তটাই তাকে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে সাহস যুগিয়েছিল।
তিনি ঠিক করেছিলেন, ‘আমি এভাবে মরতে চাই না।’ তিনি পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন কিন্তু তারপর থেকে কিছুই হয়নি।
তিনি নিজে শুধু এটুকুই করতে পেরেছেন যে তার নম্বর আর সিম কার্ডটা বদলিয়ে ফেলেছেন। যখন তার মেয়ে আস্থার কাছেও ফোন আসতে শুরু করল, তিনি ওর সিম কার্ডটাও নষ্ট করে দেন।
ভূমির পাশে ছিলেন তার বোন, তার বস এবং লোন অ্যাপ থেকে টাকা ধার নিয়ে হয়রানির শিকার হওয়া মানুষদের একটি অনলাইন গোষ্ঠী।
তবে লড়াই করার শক্তিটা সবথেকে বেশি যুগিয়েছিল তার মেয়ে আস্থা।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চই খুব ভাল কিছু করেছিলাম যে কারণে এমন একটা মেয়ে পেয়েছি।
ভূমি সিনহা বলছিলেন, ‘ও যদি আমার পাশে না দাঁড়াত, তাহলে লোন অ্যাপের কারণে যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে আমিও একজন হয়ে যেতাম।’
সুর পাল্টিয়ে গেল সংস্থাগুলোর
এই প্রতিবেদনে যে সব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো আমরা ‘আসান লোন’-এর সামনে তুলে ধরেছি। কয়েকটি সূত্র মারফত পলাতক দম্পতি লিয়াং তিয়ান তিয়ান এবং পরশুরাম তাকভের কাছেও অভিযোগগুলো পাঠিয়েছি আমরা।
ওই সংস্থাটি অথবা ওই দম্পতি, কেউই জবাব দেননি।
লি জিয়াং বিবিসিকে বলেন, তিনি এবং তার কোম্পানিগুলো স্থানীয় সব আইন ও নিয়ম মেনে চলেন, কখনো এমন কোনো লোন অ্যাপ পরিচালনা করেননি যেটি এ ধরনের কাজ করে এবং লিয়াং তিয়ান ও পরশুরাম তাকভে পরিচালিত ঋণ পুনরুদ্ধারকারী সংস্থা জিয়ালিয়াংয়ের সাথে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগের তথ্য সংগ্রহ অথবা ব্যবহার করেন না।
তিনি এও বলেছেন, ‘তার ঋণ পুনরুদ্ধার করার কল সেন্টারগুলো কঠোর মান অনুসরণ করে চলে এবং তিনি সাধারণ ভারতীয়দের হয়রান করে মুনাফা লোটার কথা অস্বীকার করেছেন।’
‘ম্যাজেস্টি লিগ্যাল সার্ভিসেস’ ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য গ্রাহকদের কন্টাক্ট লিস্টে থাকা ব্যক্তিদের ব্যবহার করে না।
তারা আমাদের এটাও বলেছে যে তাদের এজেন্টদের নির্দেশ দেয়া আছে যাতে গালাগালি বা হুমকি দিয়ে গ্রাহকদের ফোন না করা হয়। সংস্থার এইসব নীতি না মানলে বরখাস্ত করারও নিয়ম আছে।
[অতিরিক্ত প্রতিবেদন করেছেন রনি সেন, শ্বেতিকা প্রসার, সৈয়দ হাসান, অঙ্কুর জৈন এবং বিবিসি আই টিম। আন্ডারকভার রিপোর্টারদেরও ধন্যবাদ, নিরাপত্তার কারণে যাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।]
সূত্র : বিবিসি