বেড়েছে প্রতিমা তৈরির খরচ, বাড়েনি শিল্পীদের পারিশ্রমিক
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আগামী ২০ অক্টোবর মহা ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে এবারের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান এই ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিমা তৈরিতে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। হাতের জাদুতে ও রং-তুলির আঁচড়ে মনের মাধুরি দিয়ে গড়ে তুলছেন দেবী দুর্গাকে। এ ছাড়া কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীসহ অন্যান্য প্রতিমাও তৈরি করছেন শিল্পীরা।
সরেজমিনে পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের শ্রীশ্রী প্রাণ বল্লভ জিঁউ মন্দিরসহ শাঁখারিবাজার ও সূত্রাপুরে দেখা যায়, প্রতিমাশিল্পীদের কেউ প্রতিমা তৈরিতে আবার কেউবা রং করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। দিনরাত এর পেছনে সময় ব্যয় করছেন তারা।
প্রতিমাশিল্পীরা বলছেন, আগের চেয়ে কাজ বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় বাড়েনি পারিশ্রমিক। এদিকে প্রতিমা তৈরির উপকরণের দামও চড়া। উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এঁটেল মাটি, বাঁশ, কাঠ, খড়, পাটের আঁশ, যা সংগ্রহ করতে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ দাম গুনতে হচ্ছে তাদের।
প্রতিমাশিল্পী বলাই পাল বলেন, আমি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে প্রতিমা তৈরির কাজ করে আসছি। এবার দেশের পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় সবাই ভালোভাবে পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে কারণে কাজ বেড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পুরান ঢাকা এই নর্থব্রুক হল রোডে আমি ১২টি প্রতিমা তৈরির কাজ পেয়েছি। পূজারিদের চাহিদা অনুযায়ী এবার প্রতিমার আকার ও ডিজাইনে ভিন্নতা এসেছে। বর্তমানে আমাদের মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষ। আর দু-এক দিনের মধ্যে পুরোপুরি রঙের কাজও শেষ করতে পারবো। পূজা শুরুর কয়েক দিন আগে প্রতিমাগুলোকে অলংকার দিয়ে সাজিয়ে পূজারিদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
প্রতিমা তৈরির ব্যয় ও নিজের পারিশ্রমিক সম্পর্কে বলাই পাল বলেন, আমরা আগে যে বাঁশ ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনতাম, এখন তা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় কিনতে হয়। আগে দুই-তিন হাজার টাকার খড় দিয়ে একটা মণ্ডবের প্রতিমা হয়ে যেত, এখন ছয় থেকে সাত হাজার টাকার খড় লাগে। খড়ের পরিমাণ একই কিন্তু দাম দ্বিগুণ। পাঁচ বছর আগে যে প্রতিমা তৈরিতে খরচ হতো ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা, এখন খরচ হয় দেড় লাখ টাকা।
তিনি আরও জানান, এখন ইন্টারনেটের যুগ। এ কারণে ইউটিউব-ফেসবুকে দেখে অনেকে কলকাতার আদলে প্রতিমা তৈরির অর্ডার দেন। আমরাও সেভাবেই প্রতিমা তৈরি করছি। তবে আমাদের দেশের চিরায়ত মলিন ভক্তিভাবাপন্ন সুদর্শন হাসিমুখের প্রতিমা বেশির ভাগ পূজারি পছন্দ করে এবং এভাবে প্রতিমা তৈরির অর্ডার দেন। এতে খরচও বাড়ে।
প্রতিমাশিল্পী বিশ্বজিৎ পাল বলেন, বংশপরম্পরায় আমি এই মৃৎশিল্পের কারিগর। আমার পূর্বপুরুষরা একই কাজ করে গেছেন। এই কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজও জানা নেই। বছরের এই সময়ে আমাদের তুমুল ব্যস্ততা যায়, বাকি সময় টুকটাক কাজ করি। অন্যরা অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সবকিছুর দাম এখন আকাশচুম্বী। তা ছাড়া অনেকে এখন মেশিন দিয়ে কাজ করে। তিন জন মজুরের জায়গায় দুজন লাগে। এ জন্য কম বেতন হলেও কাজ করা লাগে। নয়তো অন্য কোনও উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে গত কয়েক বছর কাজ বেশি পাইনি। এবার ভালো কাজ পেয়েছি। কিন্তু যে উপকরণ গত বছর ১৪ হাজার টাকায় কিনেছি, সেটা এবার ৩০ হাজার। যে রঙ ১৫০ টাকায় কিনতাম, সেটা এখন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সেই হারে পারিশ্রমিক যদি বাড়তো, তাহলে পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করতে কষ্ট হতো না।
কারিগর রাখাল পাল বলেন, বেশির ভাগ প্রতিমার কাজ প্রায় শেষ। এখন চলছে রঙ ও সাজসজ্জার কাজ। অনেকে তাদের পছন্দের শাড়ি দিয়ে দেবী দুর্গাকে সাজাতে নামিদামি রং-বেরঙের শাড়ি, অলংকার ও মাথার মুকুট দিয়ে গিয়েছে। আমরা এখন ধীরে ধীরে সেগুলোর কাজ করবো।
প্রতিমা তৈরিতে কেমন খরচ হচ্ছে এবং পূর্বের তুলনায় পারিশ্রমিক বেড়েছে কি না, এমন প্রশ্নে রাখাল বলেন, প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম বেড়েছে। প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত এক বস্তা মাটির (৫০ কেজির) দাম দুই-আড়াই হাজার টাকা। আছে পরিবহন খরচ। কিন্তু আমাদের পারিশ্রমিক বাড়েনি।
গতবারের চেয়ে এবার ভালোভাবে পূজা উদযাপনের আশা করছে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। আবার কেউ কেউ এ বছর নির্বাচনের হাওয়ায় কিছুটা শঙ্কিত।