শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২২ অপরাহ্ন

অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান

Reporter Name / ৩৬৪ Time View
Update : রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩

মারুফা হাসান

প্রতিটি নারীর সফলতার পিছনে থাকেন তিনি নিজেই। কারণ তার ইচ্ছা শক্তি এবং মনোবল তাকে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজকের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নারীর এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। করপোরেট জগৎসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহীসহ উচ্চ পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রতিবছরই এই নারী ‘বস’ বাড়ছে। সরকারি চাকরি ছাড়াও নারীরা এখন ব্যাংক, বিমা, কলকারখানার পাশাপাশি সেবা খাতের বিভিন্ন কোম্পানি চালাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা রুবানা ১৫ বছর বয়স থেকে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। সত্যিকার অর্থে মেধাবী মেয়েটি এসএসসি, এইচএসসি-দুবারই বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিলেন। মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর নির্বাচিত প্রথম নারী সভাপতি রুবানা হক। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত সাবেক মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী তিনি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম নারী মেজর জেনারেল সুসানে গীতি। মেজর জেনারেল সুসানে গীতি ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে  চিকিৎসক হিসেবে ক্যাপ্টেন পদবিতে যোগ দেন। ঈশ্বরদীর নুরুন্নাহার জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক জিতে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেন। ২০১১ সালে তিনি দেশের সেরা নারী কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি ব্রোঞ্জপদক, ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক, ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে রাঁধুনি কীর্তিমতী অ্যাওয়ার্ড, একই বছর জাতীয় সবজি পদক, ২০১৮ সালে কে আই বি পদক অর্জন করেন।
শিশুর পোশাক ও পাঞ্জাবি তৈরি করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করতেন গৃহবধূ লুৎফা সানজিদা। শুরুতে তার পুঁজি ছিল মাত্র ১৫ হাজার টাকা। পরে এ কাজে এগিয়ে আসেন তার মামাতো ভাই। তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর চকভিউ মার্কেটে একটি শোরুম দেন। সাফল্য আসতে থাকে। এখন অনিন্দ্য বুটিক হাউস ও অনিন্দ্য বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী তিনি। ১৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে ২৬ বছরের ব্যবধানে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা, কোটিপতি। তার সংগ্রামের সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রকাশিত নবম-দশম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বইয়ে। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেই চট্টগ্রামের সফল নারী উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনার লুৎফা সানজিদার বর্ণাঢ্য জীবনী তুলে ধরা হয়েছে বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ে। প্রচলিত ঘরানার বাইরে এসে নারীদের নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানোর মাধ্যমে প্রতি বছর উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস। বিশ্বব্যাপী ১৯ নভেম্বর দিবসটি পালিত হয়। বিশ্বের ১৬০টি দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্বে উদ্যোক্তা সপ্তাহ পালিত হয়। বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার কম-বেশি এক-তৃতীয়াংশ নারী। নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। পরিবার, আর্থসামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, পারস্পরিক সহযোগিতা, আর্থিক সহায়তা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের দিক থেকে অবস্থা অনুকূলে না থাকলেও নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুযোগ পেয়ে নয়, প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই তারা সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। নারী উদ্যোক্তার এই বিপুল সম্ভাবনা শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা মেলে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার। যারা সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
বর্তমানে দেশে যত মানুষ অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছে এর অর্ধেকই নারী ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা। এই উদ্যোক্তারা নিজের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকা  আয় করছেন। ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের বড়ো পেজ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এই পেজের সদস্য সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির মধ্যে ৫০ লাখই নারী। বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী শ্রমবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর একটি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ। ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, গ্রামীণ নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি। আবার পোশাক খাত ছাড়াও এখন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ খাত, রিয়েল স্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্স খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মোট পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পোশাক খাতের পরই প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে।এখন মানুষ চাকরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছে। আর এখানে নারীরা পিছিয়ে নেই। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা করেছে। পাশাপাশি ব্যাংক লোনের ব্যবস্হা করেছে। ব্যাংকগুলোকে নারীবান্ধব করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঘুর্ণিওমান মূলধন দেওয়া হয়েছে।নারী উদ্যোক্তাদের উৎপন্ন পণ্য বাজারজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ারও ব্যবস্হা রয়েছে। নারীরা আজ অনেক এগিয়েছে।  তাদের প্রাপ্তিও কম নয়। আর এজন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে। নারী অনেক জায়গায় খুব সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। পৃথিবীর উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।  প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা কৃষিখাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন কুটিরশিল্পের জন্য এনজিও এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কাজ করে। এসব নারীরা ভাগ্যের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প সুদে কৃষি ও কুটিরশিল্প ঋণ নিয়ে এখন নিজেরাই উদ্যোক্তা। এভাবে তারা ঋণ শোধ করে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাগণ অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তারা যেকোনো কাজে পুরুষের সমান দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। তারা যেকোনো কঠিন কাজও দেখে দেখে শিখে নিতে পারেন। তবে তাদের অর্থায়ন প্রাপ্তিতে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণির ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের ঋণদান এবং অন্য সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এখনো ততটা উদার নয়। সহজ অর্থায়ন প্রাপ্তি নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড়ো সমস্যা। যদিও নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণদানের ব্যবস্হা রয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানত দেওয়া একটি কঠিন কাজ। কারণ নারীরা চাইলেই স্বামী অথবা পৈত্রিক সম্পত্তির মালিকানা পেতে পারেন না। এজন্য তাদের অনেক দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই ব্যাংক ঋণদানের সময় যখন সম্পত্তি বন্ধক নিতে চায়, তখন নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়ে যান।অর্থায়নের অভাবে নারী উদ্যোক্তাগণ ঠিকমতো বিকশিত হতে পারছেন না। এমনকি অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তাই জানেন না, তাদের জন্য সরকার কী সুবিধা প্রদান করেছে। বাংলাদেশে যারা নারী উদ্যোক্তা, তাদের অধিকাংশই কুটিরশিল্প এবং অতি ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা।  সরকার নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন এবং অর্থায়নের জন্য পর্যাপ্ত পলিসি সাপোর্ট দিয়েছেন। এগুলো কাজে লাগিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন ও বিকাশের জন্য সরকারের দেওয়া নীতি সহায়তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে নারী উদ্যোক্তাগণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করতে হবে,তাদের সচেতন করতে হবে,তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।তাদের ক্ষমতায়নসহ দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে বাংলাদেশে উত্তরণ সম্ভব হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর