চিরচেনা সিকিম আজ ভালো নেই, ভাসিয়ে নিচ্ছে তিস্তা
সিকিম তার অপরূপ রূপে এতোদিন ভুলিয়ে এসেছে বহু ভ্রমণপিয়াসু মানুষের মন। সেই চিরচেনা সিকিম আজ ভালো নেই। প্রাণবন্ত প্রকৃতি এখন পরিণত হয়েছে বিধ্বস্ত এলাকায়। ভয়াবহ বন্যায় সিকিম যেন তিস্তার পানিতে ভেসে যাচ্ছে তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে।
ভারতের আকর্ষণীয় ভ্রমণ এলাকা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিম মেঘভাঙা বৃষ্টিতে কার্যত বিপর্যস্ত। এখন পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নিহতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। গত কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টিপাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪০ জন, নিখোঁজ শতাধিক এবং আটকে আছেন বহু মানুষ। চির সৌন্দর্যের প্রাণবন্ত সেই লোনার্ক হ্রদ ভেসে গেছে। পাহাড়ি কন্যা লাচেন এবং লাচুংয়ে আটকে আছেন ৩০০০ পর্যটক।
নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ পেতে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩ জন সেনা সদস্য রয়েছেন। পাকিয়ং জেলার বারদাং এর একটি সেনা ক্যাম্প তিস্তা নদীর পানিতে ভেসে গিয়ে এই ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত একজন সেনা সদস্যকে উদ্বার সম্ভব হলেও বাকিদের কোনো খবর নেই। অশান্ত এই পরিস্থিতিতে সিকিমে কেউ ভালো নেই। শুধুই বাড়ছে মৃতদেহের সংখ্যা।
তিব্বতীয় সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত পাহাড়ি গ্রাম লাচেন এবং লাচুং। বৌদ্ধ ধর্মের প্রাণকেন্দ্র মনেস্ট্রি স্থাপনা, ইয়ামথাং ভ্যালি সংলগ্ন সিংবা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্য, পাইনের ঘন অরণ্যের মধ্যে প্রবহমান জলপ্রপাত, আর প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত উষ্ণ ঝরনার সৌন্দর্য দেখতে সারা বিশ্বের মানুষরাই এখানে ভিড় জমায়। গ্যাংটক থেকে মাত্র ৬ ঘণ্টার দূরত্বে লাচুং। ইয়ামথাং ভ্যালি থেকে যাত্রা শুরু করে লাচেন পর্যন্ত সম্পূর্ণ জায়গাটি প্রকৃতিপ্রেমী অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু রডোডেনড্রন ভ্যালি ট্রেকের বেস ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত লাচুং আজ বিধ্বস্ত। প্রায় তলিয়ে গেছে প্রকৃতির রাণী লাচেন। ভালো নেই মাঙ্গান জেলার চুংথাং, গ্যাংটক জেলার ডিকচু ও সিংটাম এবং পাকিয়ং জেলার রাংপো এলাকাও।
সিকিমের লাচেন উপত্যকার লোনাক হ্রদের ওপরে গত মঙ্গলবার ও বুধবার (৩ ও ৪ অক্টোবর) মাঝরাতের পর থেকে মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়। টানা বৃষ্টিপাত এখনও চলমান থাকায় পরিস্থিতির আরও অবণতি হচ্ছে।
হিমালয়ান হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘হিমালয়ার ছোট এই রাজ্যে আটকে পড়া পর্যটকদের সরিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায় এখন এয়ারলিফটিং। পর্যটকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে আনার কথা ভাবছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী। শুক্রবার (৬ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এই তথ্য জানায়। তবে এলাকায় এখনও চলমান বৃষ্টিপাতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেই এয়ারলিফটিং-এর কাজ করা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তিনি বলেন, আটকে পড়া পর্যটকদের কী অবস্থা তা জানার জন্যও আমরা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের পরিবারের লোক আমাদের ফোন করছেন। তারা তাদের আটকে পরা আত্মীয়ের কথা জানতে চাইছেন কিন্তু আমরা কোনও উত্তর দিতে পারছি না।’
জাতীয় সড়ক ১০-এর বিভিন্ন জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সিকিম এবং কালিম্পং কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এই এলাকায়গুলো মাঙ্গান জেলার অন্যান্য অংশ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের জীবনমানে এসেছে চরম দুর্ভোগ। ভ্রমণপিয়াসুদের আনন্দঘন সময় উপহার দেওয়া সহজ সরল মানুষরা এখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন।
ভারতের একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, ভয়াবহ বন্যায় সীমান্ত সড়ক সংস্থার অধীনে ৯টি এবং রাজ্য সরকারের অধীনে ৫টিসহ মোট ১৪টি সেতু ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সিকিম সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের অধীনে এই বিপর্যয়কে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। চুংথাংয়ের তিস্তা বাঁধে কাজ করা প্রায় ১৪ জন শ্রমিক এখনও টানেলে আটকা পড়ে আছেন।
ইতিমধ্যে আবহাওয়া বিভাগ ও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, নিম্নচাপের কারণে হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পানি মিলিয়ে এই পরিস্থিতি অন্তত আরও দুই দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাংলাদেশে পানি ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চরে তিস্তা নদী তীরবর্তী পাঁচ জেলা-লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাস জানানো হয়। সিকিমের বন্যা পরিস্থিতি বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলছে।