আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন দুর্ঘটনায় দোষারোপের লড়াই যেন থামছেই না। গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফাইট ১৭১-এর ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় ২৬০ জনের বেশি নিহত হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পরও তদন্ত ঘিরে চলছে বিতর্ক। এবার বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করলো ভারতের সুপ্রিম কোর্টও।
গত ১২ জুনের ওই দুর্ঘটনায় প্লেনটি উড্ডয়নের মাত্র ৩২ সেকেন্ড পর একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। গত জুলাইয়ে প্রকাশিত অন্তর্র্বতী প্রতিবেদনে মূলত পাইলটদের ত্রুটিকে দায়ী করা হলেও সমালোচকরা বলছেন, এতে প্লেনের যান্ত্রিক ত্রুটির আশঙ্কাকে আড়াল করা হয়েছে।
গত শুক্রবার (৭ নভেম্বর) ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্যকান্ত বলেন, ‘কারও উচিত নয় প্লেনের ক্যাপ্টেনকে দোষ দেওয়া।’ তার এই মন্তব্যের এক সপ্তাহ আগে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী ক্যাম্পবেল উইলসন দাবি করেন, প্লেন বা এর ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা ছিল না।
নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘অ্যাভিয়েশন ইন্ডিয়া ২০২৫’ সম্মেলনে উইলসন বলেন, ‘এই দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, তাদের পরিবার এবং আমাদের কর্মীদের জন্য সম্পূর্ণ বিধ্বংসী।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, প্লেনে, ইঞ্জিনে বা পরিচালনায় কোনো সমস্যা ছিল না।’
দুর্ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে ভারতের এয়ার অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)। তবে যেহেতু প্লেন ও ইঞ্জিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি, তাই মার্কিন কর্মকর্তারাও তদন্তে অংশ নিচ্ছেন।
দোষ আসলে কার?
দুর্ঘটনার এক মাস পর প্রকাশিত প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ড পর ‘ফুয়েল কাটঅফ সুইচ’ ভুলবশত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইঞ্জিনে জ্বালানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তা ফের চালু করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, ককপিট রেকর্ডিংয়ে এক পাইলট অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কেন জ্বালানি বন্ধ করলেন?’ জবাবে অন্যজন বলেন, ‘আমি করিনি।’ এই সংলাপ থেকেই দুই পাইলট—ক্যাপ্টেন সুমিত সাবরওয়াল ও ফার্স্ট অফিসার কাইভ কুন্দের ভ‚মিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়।
তবে ভারতের আকাশ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন অমিত সিং দাবি করেছেন, ‘উপলব্ধ প্রমাণগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে, দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল বৈদ্যুতিক গোলযোগ, যা ইঞ্জিনের জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘ফুল অথরিটি ডিজিটাল ইঞ্জিন কন্ট্রোল’ (এফএডিইসি) নামের কম্পিউটার সিস্টেমে ত্রুটির কারণে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে থাকতে পারে, পাইলটরা তা ছোঁয়নি।
ক্যাপ্টেন সিং সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেছেন, প্রাথমিক রিপোর্ট এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে মনে হয় এটি পাইলটের ভুল। কিন্তু এতে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো গোপন রাখা হয়েছে।
মামলা উঠলো সুপ্রিম কোর্টে
এই প্রেক্ষাপটে ক্যাপ্টেন সাবরওয়ালের ৯১ বছর বয়সী বাবা পুষ্কররাজ সাবরওয়াল সুপ্রিম কোর্টে স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন জানান। শুনানিতে বিচারপতি সূর্যকান্ত তাকে বলেন, ‘এই দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্তু আপনার ছেলেকে দোষ দেওয়া যায় না।’ মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ১০ নভেম্বর।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর অ্যাভিয়েশন সেফটি (এফএএস)-এর প্রতিষ্ঠাতা এড পিয়ারসন বলেছেন, ‘প্রাথমিক প্রতিবেদনটি অপ্রতুল ও বিব্রতকরভাবে একপেশে।’ তার মতে, তদন্তে প্লেনের বৈদ্যুতিক সমস্যার আশঙ্কা পর্যাপ্তভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। বরং পাইলটদের দিকে দোষ চাপানোর চেষ্টা হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পরিবহন দপ্তরের ইন্সপেক্টর জেনারেল মেরি সিয়াভো মনে করেন, তদন্তকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, তাড়াহুড়ো করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, এমন দুর্ঘটনার চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন ১২ মাসের মধ্যে প্রকাশের কথা। তবে এখন পর্যন্ত সেটি প্রকাশিত হয়নি। ফলে এই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। বোয়িং কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭৮৭ মডেলের প্লেনটি নিরাপদ এবং এ সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব ভারতের এএআইবির।